তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?
নদীর অবিশ্রান্ত বহমান স্রোতের ধ্বনির মধ্যে লেখক শুনতে পেতেন, ‘মহাদেবের জটা হইতে।’ লেখক অবশ্য নদীর এই উত্তর শুনে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেননি, তিনি বেরিয়েছিলেন ভাগীরথীর উৎসসন্ধানে। বহু পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে বহু পথ পার হয়ে দেখে এসেছিলেন নদী কোথা হইতে আসে, দেখেছিলেন ভাগীরথীর উৎসের এক আশ্চর্য রূপ – সেই কুজ্ঝটিকাময় জটাজাল।
বাংলা সাহিত্যে নদীর কথা ভাবতে গিয়ে আমাকেও রওনা হতে হল নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের সন্ধানে। নদীমাতৃক বাংলার সাহিত্যরচনার একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। প্রাচীনকালে এক জনপদের সঙ্গে আর এক জনপদের যোগাযোগের সূত্র বলতে ছিল প্রধানত নদীই। নদীর দু’পার জুড়ে সভ্যতার গড়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। বাঙালির নিশ্চয়ই মনে পড়ে যায় সরস্বতীর মজে যাওয়া ও সপ্তগ্রামের বাণিজ্য হ্রাসের গল্প। যে কারণের ফলে সপ্তগ্রামের বাসিন্দারা বাস উঠিয়ে চলে এল হুগলি নদীর মোহানার তীরে। সেই পত্তন জন্ম দিয়েছিল সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুরের যা ক্রমে খ্যাত হয়েছে শহর কলকাতা নামে। এরকম বহু নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বাংলার নানা জনপদ, সেই জনপদের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, উল্লাস-যন্ত্রণা ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে রচিত হয়েছে বহু বিখ্যাত উপন্যাস। বহু উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্পের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে নদী ও নদীর অনুষঙ্গ।
আচার্য জগদীশচন্দ্র নদীর উৎস খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন দুর্গম পথে। আমার শৈশব-কৈশোরের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক নদী – ইছামতী। ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি দেশভাগ হওয়ার পর তিনটি পরিবার রাতারাতি বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষক আর রান্নার সরঞ্জাম গরুর গাড়িতে চাপিয়ে চলে এসেছিল এপার বাংলায়, ইছামতীর ধারে পতিত জমির ঝোপজঙ্গল কেটে বসতি গড়েছিল তারা। আমি ছিলাম তারই একটি পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ইছামতী আমার নিত্যসঙ্গী। বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেলাধুলোর পাট না-থাকলে আমরা ছোটোরা গিয়ে বসতাম ইছামতীর তীরে পা ঝুলিয়ে, ভাটা থাকলে সেই নদীর রূপ একরকম, জোয়ার এলে সেই ইছামতীই উঠত ফুলেফেঁপে, জল বাড়তে বাড়তে একসময় ইছামতীর জল এসে ছুঁয়ে যেত পায়ের পাতা, তারপর গ্রাস করত গোড়ালি, তারপর হাঁটু ছুঁই-ছুঁই হলেই হাফপ্যান্ট ভিজে যাওয়ার আগেই উঠে পড়তাম কিনার থেকে। তখন হয়তো চেপে বসতাম খেয়ানৌকোটিতে, তার পাটাতনে বসে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে পারাপার করতাম যতক্ষণ না ঘনিয়ে আসত অন্ধকার।
নদী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘ঘাটের কথা’ লেখা বাংলা ১২৯১ এ। গল্পটি পড়ার পর মনে পড়েছিল নিচু ক্লাসে প্রায়ই একটি রচনা লিখতে হত সে সময় – ‘একটি নয়াপয়সার আত্মকাহিনি’ বা ‘একটি নদীর আত্মকথা’ বা ‘একটি রাজপথের কাহিনি’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর তিরিশ বছর বয়সে জীবনের তৃতীয় গল্পে একটি ঘাটের জবানিতে বলেছেন কুসুম নামের একটি কিশোরীর করুণ কাহিনি। নদীর ঘাটে সারাদিনে কত মানুষ আসে কত কাজে, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু গল্প তৈরি হতে থাকে তাদের অজান্তেই। নদীর ঘাট সেই কাহিনীর নীরব সাক্ষী। সেই নীরবতা ভেঙে ঘাট গল্প বলে চলেছে এক অদৃশ্য শ্রোতার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার চেয়েও করুণ কাহিনি লিখেছেন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে। বহুকাল পরে এই সেদিনও রতনের কথা পড়তে গিয়ে চোখের কোণে কেন ভরে এল জল তা বুঝতে গিয়ে আমি হতবাক। কৈশোরে যে গল্প পড়েছি পাঠ্যপুস্তকে, তার লাইন উদ্ধৃত করে ব্যাখ্যা করেছি, লিখেছি তার সারাংশ, সেই গল্প আজও চোখের কোল ভিজিয়ে দেয় এ তো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার! ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এ পৌঁছে সেই একই অভিজ্ঞতার শরিক। পড়তে গিয়ে মনে হয় রতন আর রাইচরণ দুই ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কোথাও যেন তাদের নিয়তি একই তারে বাঁধা।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ পড়েছি স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে উঠে। বইয়ের নাম ইছামতী উপন্যাসটির প্রতি আমার অন্য আকর্ষণ। পড়তে গিয়ে অবশ্য বুঝেছিলাম ইছামতীর তেমন প্রাধান্য নেই উপন্যাসে, নদীতীরের নীলকুঠি ও সেখানকার কর্তা শিপটনসাহেব উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। নদীপাড়ে সার সার নীলকুঠি ও সাহেবদের অত্যাচার, সেই সঙ্গে ইছামতীর তীরবর্তী মানুষদের জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার টানাপোড়েন নিয়ে এই উপাখ্যান।
নদীর প্রাধান্য আছে এমন দুটি উপন্যাসের একটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ অন্যটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। দুটি উপন্যাসের মধ্যে তুলনা হয়, আবার হয়ও না। হয়, কেন না দুটি উপন্যাসই গরিব মাছমারাদের জীবন নিয়ে রচিত। নদী যাদের ভরণপোষণের একমাত্র ভরসা, নদীর শরীর ভালো থাকলে তারা ভালো থাকে, নদীর অসুখ করলে তারাও…। আবার অনেকে তুলনা করতে চান না কারণ অদ্বৈত ছিলেন মালোপাড়ারই একজন, তিনি সেই পরিবেশ থেকে উঠে এসে রচনা করেছেন তাঁদেরই জীবন-ইতিহাস। ধনুকের মতো বাঁকা তিতাসনদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণপাড়ায় ছোটো ছোটো ঘর বেঁধে বাস করে মালো সম্প্রদায়। উপন্যাসের আরম্ভে অদ্বৈত যে দার্শনিক বচনটি সঞ্চারিত করেছেন পাঠক মনে তা উল্লেখনীয়। ‘নদীর একটি দার্শনিক রূপ রহিয়াছে। নদী বহিয়া চলে। কালও বহিয়া চলে।’ নদীর শান্ত চেহারার মতোই তাদের নিরীহ-নির্বিরোধী জীবনযাপন। লেখক তাদেরই একজন হওয়ার ফলে স্থানিক পরিসীমার মধ্যে ঘটমান কাহিনি গণ্ডির বৃত্ত অতিক্রম করে লাভ করেছে এক অসীম ব্যাপ্তি।
অদ্বৈত যে চোখে মালোদের জীবন দেখেছেন, স্বভাবতই মানিক দেখেছেন সম্পূর্ণ অন্য চোখে। মালোপাড়ার বৃত্তের বাইরে থেকে রচনা করেছেন তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’। পাঠকের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ মানিকের দেখা হবে অন্যরকম। পাঠকের মনে হতেই পারে কোনও একটি জীবন বাইরে থেকে দেখা মানে সেই দেখা অসম্পূর্ণ দেখা! কিন্তু উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠককে বলে অন্য কিছু। মানিকের উপন্যাস পড়লেই অনুভব করা যায় মানিক তাদের মধ্যে বড় না হয়ে উঠলেও তাদের দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাদের জীবনযাপন তাঁর না-জানা নয়। আর এও তো ঠিক, লেখক তো জীবন-গবেষকও। নাই বা জন্মালেন তাদের সমাজে, তাদের জীবন ঘনিষ্ঠভাবে দেখে, পর্যবেক্ষণ করে, অনুভব করে কেন লেখা যাবে না উপন্যাস! ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এক প্রান্তিক মানবজীবনের সঙ্গে নদী ও নারীর রহস্যময় ও অস্তিত্বময় সংযোগ, অন্ত্যজ জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামশীলতা, তাদের আশা-আকাঙ্খা ও অপ্রাপ্তির আখ্যান। যে-পদ্মা মানুষের অস্তিত্বগ্রাসী, তবু প্রাকৃতিক বিক্ষুব্ধতার মধ্যেও বেঁচে থাকার লড়াই এই উপন্যাসের বিষয়।
দুটি উপন্যাসেই মাছমারাদের জীবনযাপনের এক অত্যাশ্চর্য জলছবি। এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা সামান্য হলেও বলি। আমি যে গাঁয়ে বড়ো হয়েছি, সেখানে পাশাপাশি দুটো জেলেপাড়া। তার একটির সামান্য দূরত্বে আমাদের ভিটে। তাদের বাড়ির ছেলে আর আমি পড়েছি একই ক্লাসে, একই স্কুলে। সকাল বিকেল তাদের সঙ্গে দেখা। চলাচলের পথের পাশে তাদের সার সার বাড়ি। তারা বাড়ির পুরুষেরা উঠোনে বসে জাল বোনে, সেই জাল বোনা দেখা ছিল আমাদের প্রিয় বিলাস। তারা নদীতে গিয়ে খ্যাপলা জাল ছুঁড়ে মাছ ধরার সময় আমরা প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করতাম কী কী মাছ উঠে আসবে তাদের জালে। দু-একবার আমরাও তাদের জাল হাতে নিয়ে কায়দা করে ছুঁড়ে দেখতে চেষ্টা করেছি কী মাছ ধরা পড়ে আমাদের এলেমে। তাদের পাড়ায় মনসার ভাসান শুরু হলে সেই গান চলত টানা তিনদিন তিনরাত। তাদের বাড়ির মেটে দাওয়ায় জেলেপাড়ার যাবতীয় মেয়ে-বউ দল বেঁধে গাইত কখনও কোরাসে, কখনও সোলো। গান চলত রিলে রেসের মতো। টানা তিন কি চার ঘণ্টা গাইবার পর একদল উঠে চলে যেত তাদের রান্নাবাড়া করতে, খেতে বা শুয়ে বিশ্রাম নিতে, অন্যদল শুরু করত সেই ফেলে যাওয়া গানের শেষ পঙতি থেকে। সেই গান শুনতে আমাদের বামুনপাড়ার সবাই ভিড় জমাত সকাল-সন্ধে। কখনও গান শুনতে অনেক রাত হয়ে যেত। ইছামতীতে মাছ-ধরা, ইছামতীতে মাছ কমে এলে মাছের তল্লাসে তাদের পুরুষদের সমুদ্রে বেরিয়ে পড়া ছিল রোজনামচার মতো। ডিঙি সাজিয়ে সেই সমুদ্রযাত্রা ছিল এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সেই বিবরণ লিখেছিলাম ‘সমগ্র শঙ্খচিল’ গ্রন্থে।
আমি অনুভব করেছি অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসের সুর যে-তারে বাঁধা থাকবে তা সম্ভব নয় মানিকের পক্ষে। কিন্তু মানিকের দেখা এক অন্য দেখা। একটু দূর থেকে দেখলে মানুষের জীবনের অনেক ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দেখার মূল্য অন্যরকম। নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস বলতে মনে পড়ে ‘নদী ও নারী’র কথা। হুমায়ুন কবীরের চার খণ্ডে ভাগ করা এই উপন্যাস তেমন মহাকাব্যিক জীবনের আধার না-হলেও ডকুমেন্টেশন লক্ষ্য করার মতো। এখানেও নদীর নাম পদ্মা। পদ্মা পেরিয়ে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে ঝড়ে পড়ে নজুমিয়া, সেই ঝড় কাটিয়ে সে আর ঘরে ফিরতে পারেনি, ফলে ঝড় উঠেছিল উপন্যাসের অন্য চরিত্রদের মধ্যে। নজুমিয়ার মৃত্যুর পর নতুন পঞ্চায়েত হল তারই বন্ধু আসগর, শুধু তাই নয়, নজুমিয়ার ছেলে মালেকের দায়িত্বও নেয় আসগর। আসগরের স্ত্রী আমিনার সন্তান নূরের প্রেমে পড়ে যায় ডাগর হয়ে ওঠা মালেক, ঠিক তখনই জানা যায় আমিনা আগে ছিল নজুমিয়ারই স্ত্রী, তারই গর্ভে মালেকের জন্ম। আসগরের প্রেমে পড়ে আমিনা পালিয়ে যায় তার সঙ্গে। অতএব মালেক ও নূর একই মায়ের সন্তান। এই ভয়ংকর জটিলতার আবর্তে পড়ে মালেক পালিয়ে যায় বহু দূরে, নূরের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পদ্মানদী এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হলেও মুসলমান সমাজের এক অদ্ভুত জটিল সম্পর্ক নিয়েই এই উপন্যাস।
সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’র কাহিনিও গঙ্গার তীরবর্তী জনপদের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন, চারমাস মিঠেজলে মাছ ধরে জেলেরা। এখানেও তৈরি হয়েছে নদী ও নারী নিয়ে এক অন্য টানাপোড়েন। আতপুরের মাঝিমাল্লাদের জীবন, বিলাস-পাঁচু-অমৃতের বউ হিমিকে নিয়ে আর এক জটিলতা।
নদীপারের জীবন নিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে এত সব বিখ্যাত উপন্যাস, নদীর আরও বহু রূপ আছে যা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়েছে লেখকের কলমে। নলিনী বেরার উপন্যাস ‘শবরচরিত’ এ ধরা পড়েছে সুবর্ণরেখার ধারা। কখনও ভেসে উঠেছে কবিতার মতো ধ্বনি ছড়িয়ে ছোট্ট ডুলুং। ডুলুং। আমার ছোটোবেলায় ঠাকুর্দা প্রায়ই বলতেন, ‘নদীর ধারে বাস/ভাবনা বারোমাস।’ কেমন ভাবনা তা তখন ঠিক বুঝিনি। নদীর ধারে বসে এক-একটা বিকেল ভরে তোলা রকমারি অভিজ্ঞতায়, তা মন্দ কী! বেশ কাটছিল নদীর সান্নিধ্যে, হঠাৎ একদিন শোনা গেল ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসছে ইছামতীতে। সবাই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি উঁচু হয়ে আসা সেই বান দেখতে, তিনি এলেনও দু-কূল প্লাবিত করে, কী উঁচু সেই বানের জল! একটু পরেই বানের জল ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। কিনার ছাপাতে পিছু হঠতে শুরু করি আমরা। দেখি কি, আমাদের পিছনে ধাওয়া করে আসছে বানের স্রোত। ছুটতে ছুটতে বাড়ির চৌহদ্দির ভিতর ঢুকেও দেখি জল আমাদের পিছু ছাড়েনি। উঠোনে তখন গলগল করে জল ঢুকছে। একহাঁটু জল হতেই আমাদের বুকে একই সঙ্গে ত্রাস ও উল্লাস। নদী তা হলে আমাদের উঠোনেও চলে এসেছে এতদিনে! উঠোনে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে ঘুরছি ফিরছি, হঠাৎ দেখি কি, কাকারা আর ঠাকুর্দা-ঠাকুমা মিলে হুড়োহুড়ি করছেন এ-ঘরে ও-ঘরে। সংবিৎ ফিরতে বুঝি উঠোনের জল আর একটু বাড়লেই তো ঢুকে পড়বে ঘরের ভিতর। মেঝেয় ছড়ানো যাবতীয় সংসারের জিনিসপত্র ভিজে একশা হবে এক্ষুনি। তার একটু পরেই অবশ্য ভাটা পড়ে যাওয়ায় জলের গতি রুদ্ধ। ইছামতী যেমন এসেছিল গা দুলিয়ে তেমনই ফিরে যেতে শুরু করে একটু-একটু করে। তারপর আরও দু-দিন সকাল-সন্ধে নদীর এমন বাড়বাড়ন্ত চেহারা। ততদিনে পঞ্জিকার তিথি প্রতিপদ পেরিয়ে দ্বিতীয়া-তৃতীয়ার দিকে ধাবমান, ফলে নদীর পক্ষে আর আমাদের উঠোনে বেড়াতে আসা সম্ভব হয়নি। কলেজে পড়তে কলকাতা চলে আসায় সেই নদীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি বহুকাল। অনেক বছর পরে একদিন দেশের বাড়িতে গিয়ে নদীর সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্ব ঝালাই করতে গিয়ে আঁতকে উঠে দেখেছিলাম নদী আর নদী নেই, চড়া পড়ে এই এতটুকুনি। সেই খেয়া তো নেইই, মজে আসা নদীর উপর একটা কাঠের সেতু। নীচে চরের রাজত্ব।
নদীর চর নিয়েও বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে অনেক বিখ্যাত উপন্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ উপন্যাসে মাটি ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কী তা নিয়েই টানাপোড়েন। মূল চরিত্র কালিন্দীর চর। চর মানেই উর্বর ভূমি, ফসল ফোটানোর অপেক্ষায় তার মাটি। তার ঐশ্বর্য আবিষ্কৃত হওয়ার পর মাটির কাছাকাছি যারা সেই সাঁওতালরা দাবি করে এ চর তাদের। মাটির কাছে তাদের দাবি খাদ্যের। সম্পন্ন সদগোপ চাষিরাও লোলুপ হয়ে দাবি করে সেই মাটির। তাদের দাবি শুধু খাদ্য নয়, মুনাফাও। তারপর এল জমিদার যিনি প্রভুত্বও চান। মনে পড়ে আবদুল জব্বারের ‘ইলিশমারির চর’ এর কথাও। এ উপন্যাস মাছমারা জয়নদ্দি, কানাই ও হরেনের গল্প। এ উপন্যাস তাদের মহাজন তরবদির অত্যাচার, চোখরাঙানির গল্পও। জয়নদ্দিরা মাছ ধরতে সমুদ্রযাত্রায় যায়, ফিরে এসে দেখে তাদের ফেলে যাওয়া সংসার তরবদির কৃপায় তছনছ। হরেনের হাতে খুন হয় তরবদি।
নদীর স্রোত অবরুদ্ধ হলে নদীমাতৃক জনপদের জীবনযাপনও রুদ্ধ হয় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে। একজন যাত্রী অন্য স্টিমারযাত্রীদের একটি শহরের গল্প বলে যাচ্ছে, আর এক যাত্রী ওই গল্পটি শুনতে শুনতে নিজেও শোনাচ্ছে আর এক ব্যাক্তির গল্প। স্টিমার বন্ধ হয়ে যাওয়া ও তা নিয়ে তৈরি হওয়া আতঙ্ক – উপন্যাসের চরিত্রদের নানা স্বরের মধ্যে নদীর এই কান্না ঘুরে ফিরে বেড়ায় হাওয়ায়। আকাশে বাতাসে শুধু কান্নার স্বর।
ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়য়ের ‘চর পূর্ণিমা’ আর এক আখ্যান যার অবস্থান হুগলী নদীর তীরবর্তী স্থানে। দীর্ঘকাল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আবহে বেড়ে ওঠা লেখকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে একালের এক গঙ্গাবিধৌত জনপদের কাহিনি। চর পড়তে পড়তে নদী আবার কখনও হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এ সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট লেখকের কলমে পাওয়া গেল এমন আশ্চর্য পটভূমিকার সব উপন্যাস। ভগীরথ মিশ্রের ‘শিকলনামা’ উপন্যাসের একটি খণ্ডে হারানো নদী যমুনা(খাল)-কে খুঁজে বার করার কাহিনি বিবৃত হয়েছে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। চব্বিশ পরগণা ছুঁয়ে যমুনা একসময় কোথায় যে হারিয়ে গেল তা গবেষকের অধীত বিষয়। কিন্তু ভগীরথ মিশ্র সেই গবেষকের সীমানা অতিক্রম করে যমুনাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে।
একই বিষয় নিয়ে অমর মিত্রের ‘সোনাই একটি নদী ছিল’ উপন্যাস পড়ে আমি হতবাক। বাংলাদেশ সীমানা সংলগ্ন সোনাই নদীর অস্তিত্ব এখন মৌজা ম্যাপে, সেই হারানো নদী খুঁজতে চেয়ে এক ব্যক্তি মামলা করেছে উচ্চ আদালতে, বলেছে আমাদের ফিরিয়ে দাও সেই সোনাই নদী। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমার স্মৃতিতে উথলে উঠল একই সঙ্গে উল্লাস ও বিষাদ। শৈশবে আমার বাবা-মা-বোনরা থাকত বর্ডারের কাছাকাছি প্রথমে বিথারি, পরে পাশের গ্রাম চিতুড়িতে। দুই বাংলার সীমানা সেই ছোট্ট সোনাই। বিথারি-চিতুড়ি যেতে আমাকে বছরে এক বা দু-বার তেঁতুলিয়া ঘাট থেকে রওনা দিতে হত গয়নার নৌকায়। দুপাশে সবুজ গাছ ঝুঁকে থাকত সেই ছোট্ট নদীটির বুকে। কখনও নলখাগড়া, কখনও বেত, কখনও বাঁশঝাড়, কখনও ডুমুর, জিউলি বা আম-জাম সেই নদীর দু-তীরে। বিশেষ করে বাঁশঝাড়ের সেই মাইল মাইল দৃশ্য যেন এক আশ্চর্য ফেনোমেনন। সঙ্গে নৌকোয় বসে থাকলে ঝুঁকে পড়া সবুজ পাতালতা, বাঁশের কঞ্চি ও পাতার স্পর্শে শিরশির করত গা। ঘণ্টা আড়াই-তিনের সেই নৌকোজার্নি এক অবিস্মরণীয় কাণ্ড। অমরের উপন্যাস পড়ে সেই সোনাই এতদিনে লুট হয়ে গেছে মহাকালের গর্ভে (আসলে মানুষের গর্ভে!) জেনে খুবই নিরানন্দ অনুভব করেছিলাম সেদিন। শচীন দাসের উপন্যাস ‘অন্ধ নদীর উপাখ্যান’ খুঁজে বেড়িয়েছে আর এক বিখ্যাত নদী – হারানো আদি গঙ্গার ধারা। আদিগঙ্গা মিলিত হয়েছিল বিদ্যাধরীর সঙ্গে। সেই আদি গঙ্গা একসময় নিজেই হারিয়ে গেছে কোথায় তার উৎসসন্ধানে শচীন দাসও ঘুরে বেড়িয়েছেন তার উপন্যাসের চরিত্রের হাত ধরে। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহীন গাঙ’ আর এক নদীভিত্তিক উপন্যাস যার পরতে পরতে এক অচেনা জলকল্লোলের আশ্চর্য ধ্বনি। কিন্নর রায়ের ‘ধুলিচন্দন’এও শুনতে পাই এক চিরচেনা অথচ অচেনা নদীর স্বর।
নদীর সঙ্গে আমার আশৈশব সখ্যের কারণে আমার বহু গল্প-উপন্যাসেই নদী এসেছে ঘুরেফিরে। ‘দ্বৈরথ’ উপন্যাসের ব্যাপ্তি বিংশ শতকের শেষ কুড়ি বছর। এই বিশাল উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু এক ছোট্ট নদী কেলেঘাই – যা গ্রীষ্মকালে সরু পৈতের মতো বয়ে যায়, বর্ষায় সেই নদী দুকূল ছাপিয়ে দু’পাশের অজস্র গ্রাম ভাসিয়ে দিয়ে আবার পৌঁছে যায় মোহানায়। শুরু হয়ে যায় বানভাসি এই গ্রামগুলির রাজনৈতিক টানাপোড়েন। কেলেঘাই নদী এই উপন্যাসের মেরুদণ্ডের মতো। তাকে কেন্দ্র করেই আখ্যানের পর আখ্যান। ‘নদী মাটি অরণ্য’ আর এক সুবৃহৎ উপন্যাস। গোটা সুন্দরবনে অজস্র নদী শিরা-উপশিরার মতো বয়ে গেছে একশোর উপর দ্বীপগুলিকে ঘিরে। লক্ষ লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকা বা না-থাকা নির্ভর করে নদীগুলির জোয়ার-ভাটার উপর। আমার আরও অনেক উপন্যাসেই কোনও না কোনও ভাবে নদীর ভূমিকা এসেছে। হয়তো শৈশব-কৈশোর ইছামতীর তীরে কেটেছে বলেই নদীর উপর এই সম্মোহন। নদী এসেছে আরও বহুজনের লেখায়। নদীকেন্দ্রিক এমন বহু উপন্যাসের কথাই বলা হল না এই স্বল্পপরিসরে। হয়তো অন্য কেউ বলবেন কখনও। বলতে তো হবেই।
নদীর অবিশ্রান্ত বহমান স্রোতের ধ্বনির মধ্যে লেখক শুনতে পেতেন, ‘মহাদেবের জটা হইতে।’ লেখক অবশ্য নদীর এই উত্তর শুনে নিশ্চেষ্ট হয়ে থাকতে পারেননি, তিনি বেরিয়েছিলেন ভাগীরথীর উৎসসন্ধানে। বহু পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে বহু পথ পার হয়ে দেখে এসেছিলেন নদী কোথা হইতে আসে, দেখেছিলেন ভাগীরথীর উৎসের এক আশ্চর্য রূপ – সেই কুজ্ঝটিকাময় জটাজাল।
বাংলা সাহিত্যে নদীর কথা ভাবতে গিয়ে আমাকেও রওনা হতে হল নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের সন্ধানে। নদীমাতৃক বাংলার সাহিত্যরচনার একটি বড় অংশ গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। প্রাচীনকালে এক জনপদের সঙ্গে আর এক জনপদের যোগাযোগের সূত্র বলতে ছিল প্রধানত নদীই। নদীর দু’পার জুড়ে সভ্যতার গড়ে ওঠাটাই ছিল স্বাভাবিক। বাঙালির নিশ্চয়ই মনে পড়ে যায় সরস্বতীর মজে যাওয়া ও সপ্তগ্রামের বাণিজ্য হ্রাসের গল্প। যে কারণের ফলে সপ্তগ্রামের বাসিন্দারা বাস উঠিয়ে চলে এল হুগলি নদীর মোহানার তীরে। সেই পত্তন জন্ম দিয়েছিল সুতানুটি, কলকাতা, গোবিন্দপুরের যা ক্রমে খ্যাত হয়েছে শহর কলকাতা নামে। এরকম বহু নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বাংলার নানা জনপদ, সেই জনপদের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ, প্রেম-বিরহ, উল্লাস-যন্ত্রণা ও বেঁচে থাকার সংগ্রাম নিয়ে রচিত হয়েছে বহু বিখ্যাত উপন্যাস। বহু উল্লেখযোগ্য ছোটোগল্পের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে নদী ও নদীর অনুষঙ্গ।
আচার্য জগদীশচন্দ্র নদীর উৎস খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছিলেন দুর্গম পথে। আমার শৈশব-কৈশোরের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে এক নদী – ইছামতী। ঠাকুর্দার মুখে শুনেছি দেশভাগ হওয়ার পর তিনটি পরিবার রাতারাতি বিছানা-বালিশ-লেপ-তোষক আর রান্নার সরঞ্জাম গরুর গাড়িতে চাপিয়ে চলে এসেছিল এপার বাংলায়, ইছামতীর ধারে পতিত জমির ঝোপজঙ্গল কেটে বসতি গড়েছিল তারা। আমি ছিলাম তারই একটি পরিবারের কনিষ্ঠতম সদস্য। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে ইছামতী আমার নিত্যসঙ্গী। বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে খেলাধুলোর পাট না-থাকলে আমরা ছোটোরা গিয়ে বসতাম ইছামতীর তীরে পা ঝুলিয়ে, ভাটা থাকলে সেই নদীর রূপ একরকম, জোয়ার এলে সেই ইছামতীই উঠত ফুলেফেঁপে, জল বাড়তে বাড়তে একসময় ইছামতীর জল এসে ছুঁয়ে যেত পায়ের পাতা, তারপর গ্রাস করত গোড়ালি, তারপর হাঁটু ছুঁই-ছুঁই হলেই হাফপ্যান্ট ভিজে যাওয়ার আগেই উঠে পড়তাম কিনার থেকে। তখন হয়তো চেপে বসতাম খেয়ানৌকোটিতে, তার পাটাতনে বসে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে পারাপার করতাম যতক্ষণ না ঘনিয়ে আসত অন্ধকার।
নদী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প ‘ঘাটের কথা’ লেখা বাংলা ১২৯১ এ। গল্পটি পড়ার পর মনে পড়েছিল নিচু ক্লাসে প্রায়ই একটি রচনা লিখতে হত সে সময় – ‘একটি নয়াপয়সার আত্মকাহিনি’ বা ‘একটি নদীর আত্মকথা’ বা ‘একটি রাজপথের কাহিনি’ ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথ তাঁর তিরিশ বছর বয়সে জীবনের তৃতীয় গল্পে একটি ঘাটের জবানিতে বলেছেন কুসুম নামের একটি কিশোরীর করুণ কাহিনি। নদীর ঘাটে সারাদিনে কত মানুষ আসে কত কাজে, তাদের প্রত্যেকের জীবনেই কিছু না কিছু গল্প তৈরি হতে থাকে তাদের অজান্তেই। নদীর ঘাট সেই কাহিনীর নীরব সাক্ষী। সেই নীরবতা ভেঙে ঘাট গল্প বলে চলেছে এক অদৃশ্য শ্রোতার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তার চেয়েও করুণ কাহিনি লিখেছেন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে। বহুকাল পরে এই সেদিনও রতনের কথা পড়তে গিয়ে চোখের কোণে কেন ভরে এল জল তা বুঝতে গিয়ে আমি হতবাক। কৈশোরে যে গল্প পড়েছি পাঠ্যপুস্তকে, তার লাইন উদ্ধৃত করে ব্যাখ্যা করেছি, লিখেছি তার সারাংশ, সেই গল্প আজও চোখের কোল ভিজিয়ে দেয় এ তো ভারী আশ্চর্য ব্যাপার! ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ এ পৌঁছে সেই একই অভিজ্ঞতার শরিক। পড়তে গিয়ে মনে হয় রতন আর রাইচরণ দুই ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও কোথাও যেন তাদের নিয়তি একই তারে বাঁধা।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইছামতী’ পড়েছি স্কুলের একটু উঁচু ক্লাসে উঠে। বইয়ের নাম ইছামতী উপন্যাসটির প্রতি আমার অন্য আকর্ষণ। পড়তে গিয়ে অবশ্য বুঝেছিলাম ইছামতীর তেমন প্রাধান্য নেই উপন্যাসে, নদীতীরের নীলকুঠি ও সেখানকার কর্তা শিপটনসাহেব উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। নদীপাড়ে সার সার নীলকুঠি ও সাহেবদের অত্যাচার, সেই সঙ্গে ইছামতীর তীরবর্তী মানুষদের জীবনযাপন ও বেঁচে থাকার টানাপোড়েন নিয়ে এই উপাখ্যান।
নদীর প্রাধান্য আছে এমন দুটি উপন্যাসের একটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ অন্যটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। দুটি উপন্যাসের মধ্যে তুলনা হয়, আবার হয়ও না। হয়, কেন না দুটি উপন্যাসই গরিব মাছমারাদের জীবন নিয়ে রচিত। নদী যাদের ভরণপোষণের একমাত্র ভরসা, নদীর শরীর ভালো থাকলে তারা ভালো থাকে, নদীর অসুখ করলে তারাও…। আবার অনেকে তুলনা করতে চান না কারণ অদ্বৈত ছিলেন মালোপাড়ারই একজন, তিনি সেই পরিবেশ থেকে উঠে এসে রচনা করেছেন তাঁদেরই জীবন-ইতিহাস। ধনুকের মতো বাঁকা তিতাসনদীর তীর ঘেঁষে দক্ষিণপাড়ায় ছোটো ছোটো ঘর বেঁধে বাস করে মালো সম্প্রদায়। উপন্যাসের আরম্ভে অদ্বৈত যে দার্শনিক বচনটি সঞ্চারিত করেছেন পাঠক মনে তা উল্লেখনীয়। ‘নদীর একটি দার্শনিক রূপ রহিয়াছে। নদী বহিয়া চলে। কালও বহিয়া চলে।’ নদীর শান্ত চেহারার মতোই তাদের নিরীহ-নির্বিরোধী জীবনযাপন। লেখক তাদেরই একজন হওয়ার ফলে স্থানিক পরিসীমার মধ্যে ঘটমান কাহিনি গণ্ডির বৃত্ত অতিক্রম করে লাভ করেছে এক অসীম ব্যাপ্তি।
অদ্বৈত যে চোখে মালোদের জীবন দেখেছেন, স্বভাবতই মানিক দেখেছেন সম্পূর্ণ অন্য চোখে। মালোপাড়ার বৃত্তের বাইরে থেকে রচনা করেছেন তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’। পাঠকের পক্ষে উপলব্ধি করা সহজ মানিকের দেখা হবে অন্যরকম। পাঠকের মনে হতেই পারে কোনও একটি জীবন বাইরে থেকে দেখা মানে সেই দেখা অসম্পূর্ণ দেখা! কিন্তু উপন্যাস পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠককে বলে অন্য কিছু। মানিকের উপন্যাস পড়লেই অনুভব করা যায় মানিক তাদের মধ্যে বড় না হয়ে উঠলেও তাদের দেখেছেন খুব কাছ থেকে। তাদের জীবনযাপন তাঁর না-জানা নয়। আর এও তো ঠিক, লেখক তো জীবন-গবেষকও। নাই বা জন্মালেন তাদের সমাজে, তাদের জীবন ঘনিষ্ঠভাবে দেখে, পর্যবেক্ষণ করে, অনুভব করে কেন লেখা যাবে না উপন্যাস! ‘পদ্মানদীর মাঝি’ এক প্রান্তিক মানবজীবনের সঙ্গে নদী ও নারীর রহস্যময় ও অস্তিত্বময় সংযোগ, অন্ত্যজ জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামশীলতা, তাদের আশা-আকাঙ্খা ও অপ্রাপ্তির আখ্যান। যে-পদ্মা মানুষের অস্তিত্বগ্রাসী, তবু প্রাকৃতিক বিক্ষুব্ধতার মধ্যেও বেঁচে থাকার লড়াই এই উপন্যাসের বিষয়।
দুটি উপন্যাসেই মাছমারাদের জীবনযাপনের এক অত্যাশ্চর্য জলছবি। এ বিষয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা সামান্য হলেও বলি। আমি যে গাঁয়ে বড়ো হয়েছি, সেখানে পাশাপাশি দুটো জেলেপাড়া। তার একটির সামান্য দূরত্বে আমাদের ভিটে। তাদের বাড়ির ছেলে আর আমি পড়েছি একই ক্লাসে, একই স্কুলে। সকাল বিকেল তাদের সঙ্গে দেখা। চলাচলের পথের পাশে তাদের সার সার বাড়ি। তারা বাড়ির পুরুষেরা উঠোনে বসে জাল বোনে, সেই জাল বোনা দেখা ছিল আমাদের প্রিয় বিলাস। তারা নদীতে গিয়ে খ্যাপলা জাল ছুঁড়ে মাছ ধরার সময় আমরা প্রত্যাশা নিয়ে অপেক্ষা করতাম কী কী মাছ উঠে আসবে তাদের জালে। দু-একবার আমরাও তাদের জাল হাতে নিয়ে কায়দা করে ছুঁড়ে দেখতে চেষ্টা করেছি কী মাছ ধরা পড়ে আমাদের এলেমে। তাদের পাড়ায় মনসার ভাসান শুরু হলে সেই গান চলত টানা তিনদিন তিনরাত। তাদের বাড়ির মেটে দাওয়ায় জেলেপাড়ার যাবতীয় মেয়ে-বউ দল বেঁধে গাইত কখনও কোরাসে, কখনও সোলো। গান চলত রিলে রেসের মতো। টানা তিন কি চার ঘণ্টা গাইবার পর একদল উঠে চলে যেত তাদের রান্নাবাড়া করতে, খেতে বা শুয়ে বিশ্রাম নিতে, অন্যদল শুরু করত সেই ফেলে যাওয়া গানের শেষ পঙতি থেকে। সেই গান শুনতে আমাদের বামুনপাড়ার সবাই ভিড় জমাত সকাল-সন্ধে। কখনও গান শুনতে অনেক রাত হয়ে যেত। ইছামতীতে মাছ-ধরা, ইছামতীতে মাছ কমে এলে মাছের তল্লাসে তাদের পুরুষদের সমুদ্রে বেরিয়ে পড়া ছিল রোজনামচার মতো। ডিঙি সাজিয়ে সেই সমুদ্রযাত্রা ছিল এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সেই বিবরণ লিখেছিলাম ‘সমগ্র শঙ্খচিল’ গ্রন্থে।
আমি অনুভব করেছি অদ্বৈত মল্লবর্মণের উপন্যাসের সুর যে-তারে বাঁধা থাকবে তা সম্ভব নয় মানিকের পক্ষে। কিন্তু মানিকের দেখা এক অন্য দেখা। একটু দূর থেকে দেখলে মানুষের জীবনের অনেক ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়। সে দেখার মূল্য অন্যরকম। নদীকেন্দ্রিক উপন্যাস বলতে মনে পড়ে ‘নদী ও নারী’র কথা। হুমায়ুন কবীরের চার খণ্ডে ভাগ করা এই উপন্যাস তেমন মহাকাব্যিক জীবনের আধার না-হলেও ডকুমেন্টেশন লক্ষ্য করার মতো। এখানেও নদীর নাম পদ্মা। পদ্মা পেরিয়ে খাজনা আদায়ের উদ্দেশ্যে যাওয়ার পথে ঝড়ে পড়ে নজুমিয়া, সেই ঝড় কাটিয়ে সে আর ঘরে ফিরতে পারেনি, ফলে ঝড় উঠেছিল উপন্যাসের অন্য চরিত্রদের মধ্যে। নজুমিয়ার মৃত্যুর পর নতুন পঞ্চায়েত হল তারই বন্ধু আসগর, শুধু তাই নয়, নজুমিয়ার ছেলে মালেকের দায়িত্বও নেয় আসগর। আসগরের স্ত্রী আমিনার সন্তান নূরের প্রেমে পড়ে যায় ডাগর হয়ে ওঠা মালেক, ঠিক তখনই জানা যায় আমিনা আগে ছিল নজুমিয়ারই স্ত্রী, তারই গর্ভে মালেকের জন্ম। আসগরের প্রেমে পড়ে আমিনা পালিয়ে যায় তার সঙ্গে। অতএব মালেক ও নূর একই মায়ের সন্তান। এই ভয়ংকর জটিলতার আবর্তে পড়ে মালেক পালিয়ে যায় বহু দূরে, নূরের ধরাছোঁয়ার বাইরে। পদ্মানদী এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হলেও মুসলমান সমাজের এক অদ্ভুত জটিল সম্পর্ক নিয়েই এই উপন্যাস।
সমরেশ বসুর ‘গঙ্গা’র কাহিনিও গঙ্গার তীরবর্তী জনপদের মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে। আষাঢ় থেকে আশ্বিন, চারমাস মিঠেজলে মাছ ধরে জেলেরা। এখানেও তৈরি হয়েছে নদী ও নারী নিয়ে এক অন্য টানাপোড়েন। আতপুরের মাঝিমাল্লাদের জীবন, বিলাস-পাঁচু-অমৃতের বউ হিমিকে নিয়ে আর এক জটিলতা।
নদীপারের জীবন নিয়ে যেমন বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে এত সব বিখ্যাত উপন্যাস, নদীর আরও বহু রূপ আছে যা নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ধরা পড়েছে লেখকের কলমে। নলিনী বেরার উপন্যাস ‘শবরচরিত’ এ ধরা পড়েছে সুবর্ণরেখার ধারা। কখনও ভেসে উঠেছে কবিতার মতো ধ্বনি ছড়িয়ে ছোট্ট ডুলুং। ডুলুং। আমার ছোটোবেলায় ঠাকুর্দা প্রায়ই বলতেন, ‘নদীর ধারে বাস/ভাবনা বারোমাস।’ কেমন ভাবনা তা তখন ঠিক বুঝিনি। নদীর ধারে বসে এক-একটা বিকেল ভরে তোলা রকমারি অভিজ্ঞতায়, তা মন্দ কী! বেশ কাটছিল নদীর সান্নিধ্যে, হঠাৎ একদিন শোনা গেল ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসছে ইছামতীতে। সবাই নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছি উঁচু হয়ে আসা সেই বান দেখতে, তিনি এলেনও দু-কূল প্লাবিত করে, কী উঁচু সেই বানের জল! একটু পরেই বানের জল ক্রমশ বাড়তে শুরু করে। কিনার ছাপাতে পিছু হঠতে শুরু করি আমরা। দেখি কি, আমাদের পিছনে ধাওয়া করে আসছে বানের স্রোত। ছুটতে ছুটতে বাড়ির চৌহদ্দির ভিতর ঢুকেও দেখি জল আমাদের পিছু ছাড়েনি। উঠোনে তখন গলগল করে জল ঢুকছে। একহাঁটু জল হতেই আমাদের বুকে একই সঙ্গে ত্রাস ও উল্লাস। নদী তা হলে আমাদের উঠোনেও চলে এসেছে এতদিনে! উঠোনে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে ঘুরছি ফিরছি, হঠাৎ দেখি কি, কাকারা আর ঠাকুর্দা-ঠাকুমা মিলে হুড়োহুড়ি করছেন এ-ঘরে ও-ঘরে। সংবিৎ ফিরতে বুঝি উঠোনের জল আর একটু বাড়লেই তো ঢুকে পড়বে ঘরের ভিতর। মেঝেয় ছড়ানো যাবতীয় সংসারের জিনিসপত্র ভিজে একশা হবে এক্ষুনি। তার একটু পরেই অবশ্য ভাটা পড়ে যাওয়ায় জলের গতি রুদ্ধ। ইছামতী যেমন এসেছিল গা দুলিয়ে তেমনই ফিরে যেতে শুরু করে একটু-একটু করে। তারপর আরও দু-দিন সকাল-সন্ধে নদীর এমন বাড়বাড়ন্ত চেহারা। ততদিনে পঞ্জিকার তিথি প্রতিপদ পেরিয়ে দ্বিতীয়া-তৃতীয়ার দিকে ধাবমান, ফলে নদীর পক্ষে আর আমাদের উঠোনে বেড়াতে আসা সম্ভব হয়নি। কলেজে পড়তে কলকাতা চলে আসায় সেই নদীর সঙ্গে আর দেখা হয়নি বহুকাল। অনেক বছর পরে একদিন দেশের বাড়িতে গিয়ে নদীর সঙ্গে পুরোনো বন্ধুত্ব ঝালাই করতে গিয়ে আঁতকে উঠে দেখেছিলাম নদী আর নদী নেই, চড়া পড়ে এই এতটুকুনি। সেই খেয়া তো নেইই, মজে আসা নদীর উপর একটা কাঠের সেতু। নীচে চরের রাজত্ব।
নদীর চর নিয়েও বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে অনেক বিখ্যাত উপন্যাস। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’ উপন্যাসে মাটি ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কী তা নিয়েই টানাপোড়েন। মূল চরিত্র কালিন্দীর চর। চর মানেই উর্বর ভূমি, ফসল ফোটানোর অপেক্ষায় তার মাটি। তার ঐশ্বর্য আবিষ্কৃত হওয়ার পর মাটির কাছাকাছি যারা সেই সাঁওতালরা দাবি করে এ চর তাদের। মাটির কাছে তাদের দাবি খাদ্যের। সম্পন্ন সদগোপ চাষিরাও লোলুপ হয়ে দাবি করে সেই মাটির। তাদের দাবি শুধু খাদ্য নয়, মুনাফাও। তারপর এল জমিদার যিনি প্রভুত্বও চান। মনে পড়ে আবদুল জব্বারের ‘ইলিশমারির চর’ এর কথাও। এ উপন্যাস মাছমারা জয়নদ্দি, কানাই ও হরেনের গল্প। এ উপন্যাস তাদের মহাজন তরবদির অত্যাচার, চোখরাঙানির গল্পও। জয়নদ্দিরা মাছ ধরতে সমুদ্রযাত্রায় যায়, ফিরে এসে দেখে তাদের ফেলে যাওয়া সংসার তরবদির কৃপায় তছনছ। হরেনের হাতে খুন হয় তরবদি।
নদীর স্রোত অবরুদ্ধ হলে নদীমাতৃক জনপদের জীবনযাপনও রুদ্ধ হয় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহের ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে। একজন যাত্রী অন্য স্টিমারযাত্রীদের একটি শহরের গল্প বলে যাচ্ছে, আর এক যাত্রী ওই গল্পটি শুনতে শুনতে নিজেও শোনাচ্ছে আর এক ব্যাক্তির গল্প। স্টিমার বন্ধ হয়ে যাওয়া ও তা নিয়ে তৈরি হওয়া আতঙ্ক – উপন্যাসের চরিত্রদের নানা স্বরের মধ্যে নদীর এই কান্না ঘুরে ফিরে বেড়ায় হাওয়ায়। আকাশে বাতাসে শুধু কান্নার স্বর।
ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়য়ের ‘চর পূর্ণিমা’ আর এক আখ্যান যার অবস্থান হুগলী নদীর তীরবর্তী স্থানে। দীর্ঘকাল দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার আবহে বেড়ে ওঠা লেখকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত এই উপন্যাসে বিবৃত হয়েছে একালের এক গঙ্গাবিধৌত জনপদের কাহিনি। চর পড়তে পড়তে নদী আবার কখনও হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এ সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট লেখকের কলমে পাওয়া গেল এমন আশ্চর্য পটভূমিকার সব উপন্যাস। ভগীরথ মিশ্রের ‘শিকলনামা’ উপন্যাসের একটি খণ্ডে হারানো নদী যমুনা(খাল)-কে খুঁজে বার করার কাহিনি বিবৃত হয়েছে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। চব্বিশ পরগণা ছুঁয়ে যমুনা একসময় কোথায় যে হারিয়ে গেল তা গবেষকের অধীত বিষয়। কিন্তু ভগীরথ মিশ্র সেই গবেষকের সীমানা অতিক্রম করে যমুনাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন ঔপন্যাসিকের দৃষ্টিকোণ থেকে।
একই বিষয় নিয়ে অমর মিত্রের ‘সোনাই একটি নদী ছিল’ উপন্যাস পড়ে আমি হতবাক। বাংলাদেশ সীমানা সংলগ্ন সোনাই নদীর অস্তিত্ব এখন মৌজা ম্যাপে, সেই হারানো নদী খুঁজতে চেয়ে এক ব্যক্তি মামলা করেছে উচ্চ আদালতে, বলেছে আমাদের ফিরিয়ে দাও সেই সোনাই নদী। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আমার স্মৃতিতে উথলে উঠল একই সঙ্গে উল্লাস ও বিষাদ। শৈশবে আমার বাবা-মা-বোনরা থাকত বর্ডারের কাছাকাছি প্রথমে বিথারি, পরে পাশের গ্রাম চিতুড়িতে। দুই বাংলার সীমানা সেই ছোট্ট সোনাই। বিথারি-চিতুড়ি যেতে আমাকে বছরে এক বা দু-বার তেঁতুলিয়া ঘাট থেকে রওনা দিতে হত গয়নার নৌকায়। দুপাশে সবুজ গাছ ঝুঁকে থাকত সেই ছোট্ট নদীটির বুকে। কখনও নলখাগড়া, কখনও বেত, কখনও বাঁশঝাড়, কখনও ডুমুর, জিউলি বা আম-জাম সেই নদীর দু-তীরে। বিশেষ করে বাঁশঝাড়ের সেই মাইল মাইল দৃশ্য যেন এক আশ্চর্য ফেনোমেনন। সঙ্গে নৌকোয় বসে থাকলে ঝুঁকে পড়া সবুজ পাতালতা, বাঁশের কঞ্চি ও পাতার স্পর্শে শিরশির করত গা। ঘণ্টা আড়াই-তিনের সেই নৌকোজার্নি এক অবিস্মরণীয় কাণ্ড। অমরের উপন্যাস পড়ে সেই সোনাই এতদিনে লুট হয়ে গেছে মহাকালের গর্ভে (আসলে মানুষের গর্ভে!) জেনে খুবই নিরানন্দ অনুভব করেছিলাম সেদিন। শচীন দাসের উপন্যাস ‘অন্ধ নদীর উপাখ্যান’ খুঁজে বেড়িয়েছে আর এক বিখ্যাত নদী – হারানো আদি গঙ্গার ধারা। আদিগঙ্গা মিলিত হয়েছিল বিদ্যাধরীর সঙ্গে। সেই আদি গঙ্গা একসময় নিজেই হারিয়ে গেছে কোথায় তার উৎসসন্ধানে শচীন দাসও ঘুরে বেড়িয়েছেন তার উপন্যাসের চরিত্রের হাত ধরে। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘গহীন গাঙ’ আর এক নদীভিত্তিক উপন্যাস যার পরতে পরতে এক অচেনা জলকল্লোলের আশ্চর্য ধ্বনি। কিন্নর রায়ের ‘ধুলিচন্দন’এও শুনতে পাই এক চিরচেনা অথচ অচেনা নদীর স্বর।
নদীর সঙ্গে আমার আশৈশব সখ্যের কারণে আমার বহু গল্প-উপন্যাসেই নদী এসেছে ঘুরেফিরে। ‘দ্বৈরথ’ উপন্যাসের ব্যাপ্তি বিংশ শতকের শেষ কুড়ি বছর। এই বিশাল উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু এক ছোট্ট নদী কেলেঘাই – যা গ্রীষ্মকালে সরু পৈতের মতো বয়ে যায়, বর্ষায় সেই নদী দুকূল ছাপিয়ে দু’পাশের অজস্র গ্রাম ভাসিয়ে দিয়ে আবার পৌঁছে যায় মোহানায়। শুরু হয়ে যায় বানভাসি এই গ্রামগুলির রাজনৈতিক টানাপোড়েন। কেলেঘাই নদী এই উপন্যাসের মেরুদণ্ডের মতো। তাকে কেন্দ্র করেই আখ্যানের পর আখ্যান। ‘নদী মাটি অরণ্য’ আর এক সুবৃহৎ উপন্যাস। গোটা সুন্দরবনে অজস্র নদী শিরা-উপশিরার মতো বয়ে গেছে একশোর উপর দ্বীপগুলিকে ঘিরে। লক্ষ লক্ষ মানুষের বেঁচে থাকা বা না-থাকা নির্ভর করে নদীগুলির জোয়ার-ভাটার উপর। আমার আরও অনেক উপন্যাসেই কোনও না কোনও ভাবে নদীর ভূমিকা এসেছে। হয়তো শৈশব-কৈশোর ইছামতীর তীরে কেটেছে বলেই নদীর উপর এই সম্মোহন। নদী এসেছে আরও বহুজনের লেখায়। নদীকেন্দ্রিক এমন বহু উপন্যাসের কথাই বলা হল না এই স্বল্পপরিসরে। হয়তো অন্য কেউ বলবেন কখনও। বলতে তো হবেই।
এই পৃষ্ঠাটি লাইক এবং শেয়ার করতে নিচে ক্লিক করুন